ভূমিকা
কুম্ভ মেলা বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ, যেখানে কোটি কোটি ভক্ত, সাধু-সন্ত ও তপস্বীরা একত্রিত হয়ে পবিত্র নদীতে স্নান করেন। এই মহোৎসব, যা দেবতা (Devas) ও অসুরদের (Asuras) মধ্যে অমৃত (Amrita) লাভের চিরন্তন সংগ্রামের প্রতীক, হিন্দু পুরাণ ও শাস্ত্রে গভীরভাবে প্রোথিত।
এই উৎসব শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বিশ্বাস, দর্শন, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক জাগরণের এক মিলন ক্ষেত্র। কুম্ভ মেলার ইতিহাস, মহাত্ম্য, স্থান এবং বিভিন্ন প্রকারের কুম্ভ মেলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই নিবন্ধটি পড়ুন।
কুম্ভ মেলার উৎস: পৌরাণিক পটভূমি
কুম্ভ মেলার কাহিনি সমুদ্র মন্থন (Samudra Manthan) কিংবদন্তির সাথে জড়িত, যা নিম্নলিখিত হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে:
ভাগবত পুরাণ (Bhagavata Purana) (9.4.2-28)
বিষ্ণু পুরাণ (Vishnu Purana) (1.9.3-21)
মহাভারত (Mahabharata) (আদি পর্ব, অধ্যায় 18-19)
এই কাহিনি অনুসারে, দেবতা ও অসুররা ক্ষীরসাগর (Kshirsagar) মন্থন করে অমৃত (অমরত্বের অমৃত) লাভের জন্য। মন্থনের সময় একটি স্বর্ণপাত্র (কুম্ভ) থেকে অমৃত বের হয়। অসুররা অমৃত গ্রহণ করতে চাইলে, ভগবান বিষ্ণু তাঁর মোহিনী অবতারে অমৃতপাত্র গ্রহণ করে আকাশপথে উড়ে যান।
এই আকাশযাত্রার সময় চারটি স্থানে অমৃতের কয়েকটি বিন্দু পড়ে, যা বর্তমানে কুম্ভ মেলার পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত:
প্রয়াগরাজ (Prayagraj, উত্তরপ্রদেশ) – গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থল।
হরিদ্বার (Haridwar, উত্তরাখণ্ড) – গঙ্গা নদীর তীরে।
উজ্জয়িনী (Ujjain, মধ্যপ্রদেশ) – শিপ্রা নদীর তীরে।
নাসিক (Nashik, মহারাষ্ট্র) – গোদাবরী নদীর তীরে।
কুম্ভ শব্দের অর্থ পাত্র, যা অমৃত ধারণ করেছিল, এবং মেলা শব্দের অর্থ সমাবেশ। যেহেতু এই ঘটনা জ্যোতির্বিদ্যা ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের সাথে যুক্ত, তাই এর সময়কাল নির্দিষ্ট গ্রহগত অবস্থানের উপর নির্ভর করে।
কুম্ভ মেলার ঐতিহাসিক দলিল
কুম্ভ মেলার ইতিহাস প্রায় এক হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। বিভিন্ন পাঠ্য, শিলালিপি এবং ভ্রমণকারীদের বিবরণ এই উৎসবের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে:
হিউয়েন সাঙ (৭ম শতাব্দী খ্রিস্টাব্দ): বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ সম্রাট হর্ষবর্ধনের (Harsha) (৬০৬-৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে প্রয়াগরাজে এক বিশাল ধর্মীয় সমাবেশ দেখেছিলেন, যা বর্তমান কুম্ভ মেলার সঙ্গে তুলনীয়।
আদি শঙ্করাচার্য (৮ম শতাব্দী খ্রিস্টাব্দ): হিন্দু ধর্মগুরু শঙ্করাচার্য কুম্ভ মেলার পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং সন্ন্যাসীদের এই সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেন।
মোগল শাসকদের দলিল: সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) এবং জাহাঙ্গীর (১৫৬৯-১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ) কুম্ভ মেলার ব্যাপকতা এবং তাৎপর্য সম্পর্কে তাদের রাজসভায় উল্লেখ করেন।
ব্রিটিশ শাসনামলের বিবরণ: ঔপনিবেশিক আমলের নথিতে ১৯শ শতকের কুম্ভ মেলার বিশাল আয়োজন এবং তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব উল্লেখ করা হয়েছে।
এই দলিলগুলি প্রমাণ করে যে কুম্ভ মেলা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পালিত হয়ে আসছে এবং তা যুগে যুগে বিবর্তিত হলেও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অপরিবর্তিত রয়েছে।
কুম্ভ মেলার প্রকারভেদ ও এর নামকরণের কারণ
কুম্ভ মেলা একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক চক্রের উপর ভিত্তি করে পালিত হয়, যেখানে বৃহস্পতি (Jupiter), সূর্য ও চন্দ্রের নির্দিষ্ট অবস্থান গুরুত্ব পায়। প্রধানত তিন প্রকার কুম্ভ মেলা পালিত হয়:
১. পূর্ণ কুম্ভ মেলা – প্রতি ১২ বছর অন্তর
“পূর্ণ” শব্দের অর্থ “সম্পূর্ণ”, যা বোঝায় যে প্রতি ১২ বছর অন্তর এই উৎসব পূর্ণভাবে পালিত হয়।
বৃহস্পতি গ্রহ সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরতে ১২ বছর সময় নেয়।
এটি প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী ও নাসিক-এ পালিত হয়।
২. অর্ধ কুম্ভ মেলা – প্রতি ৬ বছর অন্তর
“অর্ধ” শব্দের অর্থ “অর্ধেক”, যা বোঝায় যে পূর্ণ কুম্ভ মেলার ৬ বছর পরে এটি অনুষ্ঠিত হয়।
এটি শুধুমাত্র প্রয়াগরাজ ও হরিদ্বারে পালিত হয় এবং পূর্ণ কুম্ভের প্রস্তুতিমূলক উৎসব হিসেবে গণ্য হয়।
৩. মহা কুম্ভ মেলা – প্রতি ১৪৪ বছর অন্তর
“মহা” শব্দের অর্থ “মহান”, যা বোঝায় এটি সবচেয়ে বিরল এবং সবচেয়ে পবিত্র উৎসব।
১২টি পূর্ণ কুম্ভ মেলার পরে (১২×১২=১৪৪ বছর) এটি পালিত হয়।
কেবলমাত্র প্রয়াগরাজের ত্রিবেণী সঙ্গমে (Triveni Sangam) পালিত হয়।
সংখ্যা ১৪৪ বোঝায় পূর্ণ আধ্যাত্মিক চক্রের সমাপ্তি।
উপসংহার
কুম্ভ মেলা শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি একটি পবিত্র মহাজাগতিক ঘটনা, যা কোটি কোটি ভক্তদের আধ্যাত্মিকতা, জ্ঞান এবং মোক্ষের সন্ধানে একত্রিত করে। হিন্দু পুরাণ, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের গভীরে নিহিত এই মহোৎসব মানব সভ্যতার অন্যতম বৃহৎ আধ্যাত্মিক সমাবেশ হিসেবে আজও গুরুত্বপূর্ণ।