হিন্দু ত্রিদেবের (ত্রিমূর্তি) সংরক্ষক ভগবান বিষ্ণু, যখনই ধর্ম (ন্যায়) ক্ষীণ হয় এবং অধর্ম বৃদ্ধি পায়, তখন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। তাঁর অবতারদের বিবরণ পাওয়া যায় ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, এবং মহাভারত-এ। এই অবতারগণ বিভিন্ন কারণে অবতীর্ণ হন—ভক্তদের রক্ষা করতে, অসুরদের বিনাশ করতে এবং মহাবিশ্বে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে।
দশাবতার (দশ প্রধান অবতার)
ভগবান বিষ্ণুর দশটি প্রধান অবতারকে দশাবতার বলা হয়। এগুলি হল:
১. মত্স্য (মৎস্য অবতার)
বেদ ও প্রথম মানুষ মনুকে মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা করেছিলেন।
এক বিশাল মাছের রূপ ধারণ করে মনুর নৌকাকে নিরাপদে পথ দেখান।
গ্রন্থসূত্র: ভাগবত পুরাণ ১.৩.১৫-১৭, মৎস্য পুরাণ
২. কূর্ম (কচ্ছপ অবতার)
সমুদ্র মন্থনের সময় মন্দার পর্বতকে তার পৃষ্ঠে ধরে রাখেন।
দেবতাদের জন্য অমৃত লাভ করতে সাহায্য করেন।
গ্রন্থসূত্র: ভাগবত পুরাণ ৮.৭.৮-৯, বিষ্ণু পুরাণ
৩. বরাহ (শূকর অবতার)
পৃথিবী (ভূদেবী) কে মহাসমুদ্র থেকে উদ্ধার করেন।
দানব হিরণ্যাক্ষকে পরাজিত করেন।
গ্রন্থসূত্র: বিষ্ণু পুরাণ ১.৪.৭-১৫, ভাগবত পুরাণ
৪. নৃসিংহ (অর্ধ-সিংহ, অর্ধ-মানব অবতার)
অর্ধ-মানব, অর্ধ-সিংহ রূপে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন।
ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করেন এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন।
গ্রন্থসূত্র: ভাগবত পুরাণ ৭.৮.৬-৩১
৫. বামন (বামন অবতার)
বামন ব্রাহ্মণ রূপে রাজা বলিকে বিনয় শেখান।
তিন পা জমি চাইলে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হন।
গ্রন্থসূত্র: ভাগবত পুরাণ ৮.১৮.১২-২৯, বিষ্ণু পুরাণ
৬. পরশুরাম (যোদ্ধা ঋষি)
এক কুঠার ধারণ করে ২১ বার দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষত্রিয়দের বিনাশ করেন।
ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কর্ণের মতো মহাযোদ্ধাদের শিক্ষা দেন।
গ্রন্থসূত্র: মহাভারত, বনপর্ব ৩.৯৯.২৯৯৬-৩০০১
৭. রাম (আদর্শ রাজা)
রামায়ণ-এর নায়ক, ধর্মপরায়ণ ও কর্তব্যনিষ্ঠ।
রাবণকে বধ করে স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করেন।
গ্রন্থসূত্র: রামায়ণ, বালকান্ড ১.১.৮-৯
৮. কৃষ্ণ (দিব্য কৌশলী)
মহাভারত-এর অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র।
অর্জুনকে ভগবদ্ গীতা উপদেশ দেন।
গ্রন্থসূত্র: ভগবদ্ গীতা ৪.৭-৮, ভাগবত পুরাণ
৯. বুদ্ধ (জ্ঞানী উপদেশক)
কিছু শাস্ত্রে বলা হয়, বিষ্ণু বুদ্ধ রূপে অবতীর্ণ হন হিন্দু সমাজ সংস্কারের জন্য।
অহিংসা ও আত্মজ্ঞান প্রচার করেন।
গ্রন্থসূত্র: ভাগবত পুরাণ ১.৩.২৪
১০. কল্কি (ভবিষ্যতের অবতার)
কলিযুগের শেষে আসবেন।
সাদা ঘোড়ায় চড়ে, খড়গ হাতে নিয়ে দুষ্টের দমন করবেন।
গ্রন্থসূত্র: ভাগবত পুরাণ ১.৩.২৫
বিষ্ণুর সম্পূর্ণ অবতার তালিকা
দশাবতার ছাড়াও ভাগবত পুরাণ (১.৩.৬-২৬)-এ ২২টি অবতার বর্ণিত হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবতার:
সনৎ কুমারগণ – ব্রহ্মার মানসপুত্র, আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রচার করেন।
দত্তাত্রেয় – ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের সম্মিলিত রূপ।
কপিল – সাংখ্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা।
ঋষভ – জৈনধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর।
হয়গ্রীব – ঘোড়ামুখী দেবতা, যিনি বেদ উদ্ধার করেন।
ধন্বন্তরি – মহাসমুদ্র মন্থনে আবির্ভূত হন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক।
মোহিনী – সুন্দরী নারীর রূপে দেবতাদের মধ্যে অমৃত বিতরণ করেন।
যুগ অনুসারে বিষ্ণুর অবতার
সত্য যুগ: মত্স্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ
ত্রেতা যুগ: বামন, পরশুরাম, রাম
দ্বাপর যুগ: কৃষ্ণ, বুদ্ধ
কলি যুগ: কল্কি (এখনও আবির্ভূত হননি)
অবতারদের প্রতীকী অর্থ
প্রত্যেক অবতার মানবজাতির জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষার প্রতীক:
মত্স্য ও কূর্ম – জ্ঞান সংরক্ষণ ও সুরক্ষা।
বরাহ ও নৃসিংহ – অসুরদের বিনাশ ও ধর্ম প্রতিষ্ঠা।
বামন ও পরশুরাম – বিনয় ও ন্যায়বিচারের প্রতীক।
রাম ও কৃষ্ণ – আদর্শ রাজনীতি ও ধর্মীয় শিক্ষা।
বুদ্ধ ও কল্কি – আধ্যাত্মিক উন্নতি ও চূড়ান্ত ন্যায়বিচার।
উপসংহার
ভগবান বিষ্ণুর অবতারগণ বিশ্বে ধর্ম ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আবির্ভূত হন। শাস্ত্রসমূহে উল্লিখিত এই অবতারগণের অধ্যয়ন আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে গভীর জ্ঞান প্রদান করে।
গ্রন্থসূত্র:
ভাগবত পুরাণ – স্কন্দ ১, অধ্যায় ৩
বিষ্ণু পুরাণ – পর্ব ১, অধ্যায় ৪-৫
মহাভারত – বনপর্ব, অধ্যায় ৯৯
রামায়ণ – বালকান্ড, অধ্যায় ১
ভগবদ্ গীতা – অধ্যায় ৪, শ্লোক ৭-৮