ভূমিকা
হোলি হিন্দু ধর্মের অন্যতম রঙিন ও আনন্দময় উৎসব। এটি মন্দের উপর শুভের বিজয়, বসন্তের আগমন এবং প্রেম ও ভক্তির চিরন্তন বন্ধনের প্রতীক। ২০২৫ সালে হোলি উদযাপিত হবে ১৪ মার্চ (বৃহস্পতিবার), এবং হোলিকা দহন হবে ১৩ মার্চ (বুধবার)।
হোলির উৎসের পেছনে বহু পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দুটি কাহিনি হল প্রহ্লাদ ও হোলিকার কাহিনি (বিশ্ণু পুরাণ ও ভাগবত পুরাণ থেকে) এবং রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের লীলা (ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ ও বৈষ্ণব শাস্ত্রে উল্লিখিত)।
প্রহ্লাদ ও হোলিকার কাহিনি (ভক্তির জয় ও মন্দের পরাজয়)
কেন এটি ঘটেছিল
হোলির অন্যতম প্রধান কাহিনি হল ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত প্রহ্লাদ এবং তার নিষ্ঠুর পিতা রাজা হিরণ্যকশিপু-এর গল্প। হিরণ্যকশিপু এক অশুর রাজা ছিলেন যিনি ব্রহ্মার কাছ থেকে এমন এক বর লাভ করেন যা তাকে প্রায় অমর করে তুলেছিল। এই ক্ষমতার গর্বে, তিনি নিজেকে ঈশ্বর ঘোষণা করেন এবং সবাইকে তাকে পূজা করতে বাধ্য করেন। কিন্তু তার নিজের পুত্র প্রহ্লাদ সবসময় বিষ্ণুর প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করতেন।
হিরণ্যকশিপু তার ছেলের বিষ্ণুভক্তিতে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে হত্যা করতে বিভিন্ন চেষ্টার আশ্রয় নেন, কিন্তু প্রতিবারই ঈশ্বরের কৃপায় প্রহ্লাদ রক্ষা পান। অবশেষে, হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকা-এর সাহায্য নেন। হোলিকার একটি বর ছিল, যা তাকে আগুনে পুড়ে মরার হাত থেকে রক্ষা করত। সে প্রহ্লাদকে কোলে বসিয়ে আগুনে প্রবেশ করে। কিন্তু বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অক্ষত থাকেন এবং হোলিকা পুড়ে যায়। এই ঘটনা শুভের উপর অশুভের বিজয়ের প্রতীক।
এটি কোথায় ঘটেছিল
এই ঘটনাটি বর্তমান পাকিস্তানের মুলতান বা ভারতের হস্তিনাপুর (অধুনা দিল্লি) অঞ্চলে ঘটেছিল বলে মনে করা হয়।
এটি কবে ঘটেছিল
এই ঘটনা সত্য যুগে ঘটেছিল, যা বিশ্ণু পুরাণ (১.১৭-২০) এবং ভাগবত পুরাণ (৭.৮.৫-৭.১০.৪৫)-এ উল্লেখিত রয়েছে।
পুরাণ অনুসারে উল্লেখ
- বিশ্ণু পুরাণ – প্রহ্লাদ ও হোলিকার কাহিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
- ভাগবত পুরাণ – বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের গল্প ও হিরণ্যকশিপুর বিনাশের ঘটনা এখানে বর্ণিত হয়েছে।
- নারদ পুরাণ – হোলিকার পতনের কারণ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
এই কাহিনি থেকে উদ্ভূত রীতিনীতি
- হোলিকা দহন: হোলির আগের রাতে আগুন জ্বালিয়ে হোলিকার দহন পালিত হয়, যা মন্দ শক্তির বিনাশের প্রতীক।
রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা (আনন্দ ও ভালোবাসার উৎসব)
কেন এটি ঘটেছিল
একটি জনপ্রিয় বিশ্বাস অনুসারে, ভগবান কৃষ্ণ, যিনি কৃষ্ণবর্ণের ছিলেন, ভাবতেন যে গৌরবর্ণের রাধা তাকে গ্রহণ করবেন কি না। তার মা যশোদা তাকে পরামর্শ দেন, রাধার মুখে রঙ মেখে তাদের সমান করতে। কৃষ্ণ তাই করলেন, এবং রাধা খেলাচ্ছলে প্রতিক্রিয়া দেখালেন। এখান থেকেই শুরু হয় রঙের হোলি।
এই লীলা পরবর্তীতে ব্রজভূমি (বৃন্দাবন, মথুরা, বারসানা ও নন্দগাঁও)-তে বিশাল উৎসবের রূপ নেয়।
এটি কোথায় ঘটেছিল
এই কাহিনির স্থান ব্রজভূমি বা বর্তমান ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরা, বৃন্দাবন, বারসানা ও নন্দগাঁও।
এটি কবে ঘটেছিল
এই ঘটনা দ্বাপর যুগে, ভগবান কৃষ্ণের লীলাকালীন সময়ে ঘটেছিল।
পুরাণ অনুসারে উল্লেখ
- ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ – কৃষ্ণ ও গোপীদের হোলি উদযাপনের উল্লেখ রয়েছে।
- গর্গ সংহিতা – কৃষ্ণের শৈশব ও যৌবনের বিভিন্ন লীলার বিবরণ।
- পদ্ম পুরাণ – কৃষ্ণের হোলি লীলার উল্লেখ আছে।
এই কাহিনি থেকে উদ্ভূত রীতিনীতি
- লাঠমার হোলি (বারসানা ও নন্দগাঁও): রাধার গ্রাম বারসানায়, মহিলারা পুরুষদের লাঠি দিয়ে আঘাত করেন, যা কৃষ্ণের দুষ্টুমির প্রতীক।
- ফুলের হোলি (বৃন্দাবন): রঙের পরিবর্তে ফুল দিয়ে হোলি উদযাপন করা হয়, যা কৃষ্ণের লীলার প্রতীক।
হোলির অন্যান্য ধর্মীয় সংযোগ
১. কামদেবের আত্মবলিদান ও পুনর্জন্ম
শিব পুরাণ অনুসারে, দেবী সতীর আত্মত্যাগের পর শিব গভীর ধ্যানে মগ্ন হন। তখন প্রেমদেব কামদেব তাকে জাগ্রত করতে ফুলের তীর নিক্ষেপ করেন। এতে শিব ক্রুদ্ধ হয়ে তার তৃতীয় চক্ষু খুলে কামদেবকে ভস্ম করে দেন। পরে, দেবী রতির অনুরোধে কামদেবকে অদৃশ্য রূপে পুনর্জীবন দান করেন। হোলি এই ঘটনাকে মদন উত্সব হিসাবে উদযাপন করে।
২. ধুন্ধীর কিংবদন্তি
ভবিষ্য পুরাণ অনুসারে, রাজা রঘুর রাজ্যে ধুন্ধী নামক এক রাক্ষসী শিশুদের কষ্ট দিতো। তবে সে ছোট ছেলেদের দুষ্টুমির কাছে দুর্বল ছিল। একবার, হোলির দিনে শিশুদের আনন্দ-উল্লাসে সে পরাজিত হয় ও পালিয়ে যায়। এজন্য, হোলিতে শিশুদের আনন্দময় ক্রীড়ার ঐতিহ্য রয়েছে।
উপসংহার
হোলি কেবল রঙের উৎসব নয়, এটি হিন্দু পুরাণের এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। এটি মন্দ শক্তির বিনাশ, ভক্তির জয়, প্রেম ও আনন্দের প্রতীক।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে মূল শিক্ষা
- ভক্তির শক্তি (প্রহ্লাদের কাহিনি) – ঈশ্বরের প্রতি অটল বিশ্বাস যে কোনো বাধা দূর করতে পারে।
- শুদ্ধ প্রেম (রাধা-কৃষ্ণের হোলি) – প্রেমের মাধ্যমে সকল বাধা দূর হয়।
- বলিদান ও পুনর্জন্ম (কামদেবের কাহিনি) – প্রেম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে নতুন জীবনের জন্ম হয়।
- আত্মশুদ্ধি – হোলি পুরনো শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করার সময়।
হোলি ২০২৫ তারিখ:
- হোলিকা দহন: ১৩ মার্চ ২০২৫ (বুধবার)
- রঙের হোলি: ১৪ মার্চ ২০২৫ (বৃহস্পতিবার)
সূত্র:
- বিশ্ণু পুরাণ
- ভাগবত পুরাণ
- ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ
- পদ্ম পুরাণ
- শিব পুরাণ
- ভবিষ্য পুরাণ
শুভ হোলি! 🎨🔥🌸 জয় শ্রী কৃষ্ণ!
No comments:
Post a Comment